লোকালয় ডেস্কঃ থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া শিশু ও তাদের কোচকে উদ্ধার অভিযান আজ মঙ্গলবার আবার শুরু হচ্ছে। গত রোববার ও গতকাল সোমবার মোট আটজনকে থাম লুয়াং গুহা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনো সেখানে পাঁচজন আটকা পড়ে আছে। ডুবুরিরা উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন এ উদ্ধারকাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গুহায় আটকে থাকা চার শিশু ও তাদের কোচের শারীরিক অবস্থা ভালো আছে। তারা বন্যার পানিতে ডুবে থাকা সরু ওই গুহার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত।
উত্তরাঞ্চলীয় চিয়াং রাই এলাকার থাম লুয়াং গুহায় শিশুদের উদ্ধার অভিযানের ঘটনাটি সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে।
ওই গুহায় ঢোকার পর গত ২৩ জুন নিখোঁজ হয় ১২ খুদে ফুটবলার ও তাদের কোচ। ১২ কিশোরের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। আর তাদের সহকারী কোচ এক্কাপোল জানথাওংয়ের বয়স ২৫ বছর। তারা মু পা নামের একটি ফুটবল দলের সদস্য। নয় দিন সেখানে আটকে থাকার পর ২ জুলাই ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন তাদের সন্ধান পান। অবস্থান জানার পর ১২ কিশোর ও তাদের কোচের জন্য গুহার ভেতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করার পাশাপাশি পাঠানো হয় খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।
গতকাল উদ্ধার চারজনকেও আগের দিনের মতো সরাসরি হাতপাতালে নেওয়া হয়। তারা সুস্থ আছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। আগের দিন উদ্ধার করা চার কিশোরও হাসপাতালে সুস্থ হয়ে উঠছে। তারা গতকাল ফ্রায়েড রাইসসহ নিজেদের পছন্দের খাবার খেতে চায় বলে হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে প্রায় ১০ দিন না খেয়ে থাকায় পেটের অবস্থা চিন্তা করে তাদের সব ধরনের খাবার এখনই দেওয়া হচ্ছে না।
প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
বিবিসি বলছে, যেন ঘড়ির ঘণ্টা মেপে কাজ চলছে। অ্যাম্বুলেন্স গুহার মুখ থেকে ধীরগতিতে চলছে এবং এর আলো দেখে অনুমান করা যাচ্ছে যে শিশু উদ্ধার হচ্ছে। চারদিকে আশার কথা ছড়াচ্ছে। থাই নেভি সিলের ফেসবুক পেজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য জানানো হচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এ অভিযান চালানো হচ্ছে। অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এ কাজ চালানো হচ্ছে। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়ী হতে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের। দুই সপ্তাহ ধরে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, তা কাটতে শুরু করেছে।
গত রাতে উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার পর কারও মধ্যেই তাড়াহুড়া দেখা যায়নি। ডুবুরি দলের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রশংসা চারপাশে। আজ আরও একবার তাদের সাফল্য কামনা করবে বিশ্ববাসী।
উদ্ধারপ্রক্রিয়া
পুরো উদ্ধারপ্রক্রিয়ায় ৯০ জনের একটি ডুবুরি দল কাজ করছে। তাদের মধ্যে ৪০ জন থাইল্যান্ডের। অন্যরা বিদেশি।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে, কাদা মাড়িয়ে, কখনো চড়াইয়ে উঠে, আবার কখনো পানির নিচ দিয়ে সাঁতরে ওই কিশোরদের বের করে আনা হয়। উদ্ধারকাজের জন্য বাইরে থেকে ওই ফুটবল দলের অবস্থানস্থল পর্যন্ত দড়ি বাঁধা হয়। উদ্ধারের সময় প্রত্যেক কিশোরকে অক্সিজেন মাস্ক পরানো হয়, দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় সামনে থাকা ডুবুরির সঙ্গে। তিনি গুহায় বাঁধা দড়ি এবং কিশোরের অক্সিজেনের বোতল নিয়ে যান। কোনো সমস্যা হলে সহায়তার জন্য তাদের পেছনে ছিলেন আরেকজন ডুবুরি। গুহার সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাটি ‘টি-জংশন’ নামে পরিচিত। এই এলাকা এতটাই সংকীর্ণ যে এখানে ডুবুরিদের অক্সিজেন ট্যাংকও খুলে ফেলতে হয়। এই এলাকার আগে ‘চেম্বার-থ্রি’ নামের প্রকোষ্ঠে বেস ক্যাম্প বানানো হয়েছে। সর্বশেষ ধাপটি অতিক্রমের আগে এখানে কিছু সময় বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা হয়।
উদ্ধার অভিযানের শুরু থেকে গুহার বাইরে অবস্থান নেয় ১৩টি চিকিৎসক দল। প্রতি চিকিৎসক দলে রয়েছে একটি করে হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুলেন্স। গুহা থেকে বের করে আনার পরপরই শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তারপর তাদের হেলিকপ্টারে করে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চিয়াং রাই প্রাচানুক্রহ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
উদ্ধারকারী দলে যোগ দেন দেশ-বিদেশের এক হাজার বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে নেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তিগত সহায়তাও। থাইল্যান্ডে এ রকম গুহার মধ্যে আটকে পড়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। তবে গুহার এত গভীরে এভাবে একসঙ্গে এতজন আটকে পড়ার ঘটনা এর আগে ঘটেনি।
দুর্ঘটনা
মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের কাছে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ থাম লুয়াং গুহা থাইল্যান্ডের দীর্ঘতম গুহা। কম চওড়া আর অনেক প্রকোষ্ঠ থাকায় গুহার ভেতরে চলাচল করা কঠিন। গত শুক্রবার উদ্ধার অভিযানের একপর্যায়ে কিশোরদের অক্সিজেন সরবরাহ করে ফেরার পথে প্রাণ হারান থাই নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি সামান কুনান। নেভি সিলের অবসরপ্রাপ্ত এই সদস্য মারা যান অক্সিজেন-স্বল্পতায়। সর্বশেষ গত শনিবার অস্ট্রেলিয়ার এক চিকিৎসক গুহায় ঢুকে কোচ ও কিশোরদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে উদ্ধার অভিযান শুরু করার সবুজসংকেত দেন। তাদের অবস্থানস্থলে যাওয়ার জন্য ওই পাহাড়ে শতাধিক গর্ত করা হয়। যার মধ্যে ৪০০ মিটার গভীর গর্তও ছিল। তবে কিশোরদের কাছে পৌঁছানো যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের অবস্থান ৬০০ মিটার নিচে।
শঙ্কা কাটিয়ে ওঠা
রোববার রাতভর বৃষ্টি হওয়ায় শঙ্কাটা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সকাল হতেই পরিস্থিতি অনুকূলে। তাই পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী গুহায় আটকে পড়া কিশোর ও তাদের কোচকে উদ্ধারে দ্বিতীয় দিনের মতো শুরু হয় অভিযান। সন্ধ্যা নাগাদ বের করে আনা সম্ভব হয় চার কিশোরকে। তবে গুহার অন্ধকারে আরও একটি রাত কেটেছে বাকি চার কিশোর ও তাদের কোচের। গতকাল সন্ধ্যায় অভিযান স্থগিত করে থাইল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ জানায়, আজ তাদের উদ্ধার করা হবে।
কর্তৃপক্ষ প্রথমে বর্ষাকালটা শেষ করে ওই ১২ কিশোর ও তাদের কোচকে উদ্ধারের পরিকল্পনা করেছিল। থাইল্যান্ডে জুলাই থেকে নভেম্বর বর্ষাকাল। কিন্তু ভারী বর্ষণ আর ঝড়ের পূর্বাভাসের কারণে রোববারই চূড়ান্ত উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। সেচের কারণে গুহার ভেতর পানির উচ্চতাও কমে এসেছিল। এদিন চার কিশোরকে উদ্ধারের পর গুহায় অক্সিজেনের পরিমাণ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে এবং অক্সিজেনের বোতল প্রতিস্থাপনে ১০ ঘণ্টার জন্য উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়। গতকাল সকালে দ্বিতীয় দিনের মতো শুরু হয় উদ্ধার অভিযান।